:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
মুম রহমান

গল্পকার, অনুবাদক ও চলচ্চিত্র সমালোচক

চার্লস বুকোস্কি এক পাগলা ঘোড়া
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

চার্লস বুকোস্কি এক পাগলা ঘোড়া

একগাদা আবর্জনার ভেতর থেকে গ্যারি স্টেলা চার্লস বুকোস্কির কিছু কবিতা পেয়ে গেলেন। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস ১৯৯৬ সালের ২ জুন সে সংবাদ ছাপতে গিয়ে লিখলেন, ‘চার্লস বুকোস্কি ছিলেন আমেরিকার রাস্তার কবি। এক অমার্জিত, এক গোবর গণেশ, এক মেজাজ খারাপ মাতাল যে কিনা নোংরা কথা বলে, নোংরা কথা লিখে আর আস্বাদন করে তার নোংরা বুড়া বদলোকের এই ভাবমূর্তিখানি।’ অবশ্যই চার্লস বুকোস্কির নতুন কবিতা খুঁজে পাওয়া একটি ঘটনা, অবশ্যই সেই ঘটনা সংবাদে ছাপা হওয়ার উপযুক্ত। কিন্তু সেই সংবাদের ভাষাটিই অনেক কিছু বলে দেয়। চার্লস বুকোস্কি কে, কেমন মানুষ তিনি- তা শুধু তার জীবনীতে খুঁজলে হবে না। তার কবিতায়, তার সাক্ষাৎকারে, তার চালচলনে এবং এমনকি তার সম্পর্কে প্রথাবদ্ধ মানুষের ধারণার মধ্যেও চার্লস বুকোস্কিকে খুঁজতে হয়।

চার্লস বুকোস্কি (১৯২০-৯৪) জীবনে প্রথম সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ১৯৬৩ সালের শিকাগো লিটারারি টাইমসে। আর্নল্ড এল কেইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন, ‘শেকসপিয়ার, মিল্টন, দান্তে, র‌্যাবেলিয়াস, শোস্তাকোভিচ, লেনিন এবং/অথবা ভ্যান গঘের চেয়ে আমেরিকার মানুষের প্রতি মিকি মাউসের প্রভাব বেশি।’ তার এই মন্তব্যই বলে দেয়, তার হাত দিয়ে মার্কিন কবিতা ভিন্ন ভঙ্গি খুঁজে পাবে এবং পেয়েছিল। এ সাক্ষাৎকারেই তাকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি কেন লোকজন পছন্দ করেন না। সে পাল্টা প্রশ্ন করেছিল, ‘কে আদতে লোকজন পছন্দ করে? তুমি তেমন একজন দেখাও, আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব কেন আমি লোকজনকে পছন্দ করি না।’ এই বলে সে আরও একটা বিয়ার আনতে চলে গিয়েছিল। বদমেজাজি কিন্তু রসিক, মাতাল কিন্তু সত্য কথা বলে- এমনই সব বৈপরীত্য মিলিয়ে চার্লস বুকোস্কি সাক্ষাৎ এক রহস্যের নাম। তিনি একদিকে যেমন নন্দিত, অন্যদিকে নিন্দিত।

লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস ১৯৯৬ সালের ২ জুন সে সংবাদ ছাপতে গিয়ে লিখলেন, ‘চার্লস বুকোস্কি ছিলেন আমেরিকার রাস্তার কবি। এক অমার্জিত, এক গোবর গণেশ, এক মেজাজ খারাপ মাতাল যে কিনা নোংরা কথা বলে, নোংরা কথা লিখে আর আস্বাদন করে তার নোংরা বুড়া বদলোকের এই ভাবমূর্তিখানি।’

মার্কিন কবিতায় নায়ক নয়, চার্লস বুকোস্কি যেন এক খলনায়ক। প্রকাশ্যে কবিতার অনুষ্ঠানে টিকিট কেটে আসা দর্শকদের নিয়ে তিনি ইয়ার্কি মারেন। দর্শককে বলে বসেন, অপেক্ষা করো, একটু মাল খেয়ে নিই। মদ, জুয়া, মেয়েমানুষ নিয়েই কেটেছে ছন্নছাড়া এই বুড়োর জীবন।

হেনরি চার্লস বুকোস্কি জাতে জার্মান হলেও মার্কিন নাগরিক ছিলেন। উপন্যাস, ছোটগল্প লিখলেও আধুনিক আমেরিকান কবি হিসেবেই তিনি সারা বিশ্বে পরিচিত। লস অ্যাঞ্জেলেসে বসবাস করা এই আজব লোকটা একই সঙ্গে যেমন দারুণ আদৃত, আলোচিত ও ভয়াবহ বিশ্রীভাবে সমালোচিতও। তার লেখা ও চালচলন- উভয়ই ছিল ভীষণ বিতর্কের। বহু নারীর সঙ্গে সম্পর্ক, প্রকাশ্যে মদ্য ও ধূমপান, সাহসী রচনাশৈলী, খিস্তিখেউরের ব্যবহার তাকে বরাবর আলোচনায় রেখেছে।

ছয়টি উপন্যাস, কয়েকশ গল্প এবং কয়েক হাজার কবিতার জনক বুকোস্কির প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬০-এর অধিক। লস অ্যাঞ্জেলেসের আন্ডারগ্রাউন্ড নিউজপেপার ওপেন সিটিতে তিনি দীর্ঘদিন ‘নোটস অব আ ডার্টি ওল্ড ম্যান’ নামে কলাম লিখেছেন। সেই সব কলামে তিনি নিজেই নিজেকে নোংরা বুড়া ভাম বলতেন। ‘নোটস অব আ ডার্টি ওল্ড ম্যান’ লেখার কারণে এফবিআইয়ের মতো সংস্থা তার ওপর নজদারি জারি রেখেছিল। জনপ্রিয় এই কবি এলোমেলো জীবন যাপন করতেন। এক অর্থে তিনি খুবই সাধারণ হয়ে থাকতেন। টাইম পত্রিকা তাকে ‘মার্কিন সাধারণ জীবনের কবি’ বলে উল্লেখ করেছে। ছোট প্রকাশক আর লিটল ম্যাগাজিনেই তিনি লেখালেখি করতেন বেশি। আর অর্থের বিনিময়ে কবিতা পাঠ করতেন। আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি, সেই কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানও হতো তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই।

কিন্তু ঘোরে থাকা এক পাগলা ঘোড়ার মতো এই কবিকে তার জীবনাচরণের পাশাপাশি কবিতা দিয়ে মিলিয়ে দেখলে কিছুটা রহস্য হয়তো উন্মোচিত হয়।

আমার হৃদয়ে একটা নীল পাখি আছে যেটা
বের হয়ে আসতে চায়
কিন্তু আমি ভীষণ চতুর, আমি কেবল তাকে বের হতে দিই
রাত্রিতে মাঝে মাঝে
যখন সকলেই ঘুমন্ত।

(নীল পাখি)

ধারণা করা যায়, এই কবিতার মতোই নিজেকে দিবালোকের আড়ালে রাখেন তিনি। আসল মানুষটার মুখের ওপর নিজেই চাপিয়ে রাখেন একটি বদমাশ মুখোশ। কে জানে দুনিয়ার সাথে লড়াইয়ে এটাও কোনো কৌশল কি না। নিজের তেতাল্লিশতম জন্মদিন উপলক্ষে নিজের যে চিত্রটি তুলে ধরেন, মনে হয়, সেটিই আসল চার্লস বুকোস্কি –

একাকী শেষ হয়ে যাওয়া
একটা কক্ষের কবরে
সিগারেট ছাড়া
কিংবা মদ ছাড়া –
স্রেফ একটা বৈদ্যুতিক বাতি
এবং একটা ভুঁড়িঅলা
ধূসর চুল
এবং আনন্দিত আছে
একটা কক্ষে।

(আমার ৪৩তম জন্মদিনের কবিতা)

মার্কিন কবিতায় নায়ক নয়, চার্লস বুকোস্কি যেন এক খলনায়ক। প্রকাশ্যে কবিতার অনুষ্ঠানে টিকিট কেটে আসা দর্শকদের নিয়ে তিনি ইয়ার্কি মারেন। দর্শককে বলে বসেন, অপেক্ষা করো, একটু মাল খেয়ে নিই। মদ, জুয়া, মেয়েমানুষ নিয়েই কেটেছে ছন্নছাড়া এই বুড়োর জীবন।

চার্লস বুকোস্কি আগাগোড়াই পূর্ণাঙ্গ কবি। তিনি কোনো মেকি জীবন যাপন করেননি। যা মনে চেয়েছে, তা-ই করেছেন। যা ভেবেছেন, তা-ই বলেছেন। আর শেষ পর্যন্ত লেখাটাই তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে। আপাতভাবে তাকে যতই খামখেয়ালি আর লাগামহীন মনে হোক না কেন, লেখালেখির ব্যাপারে তিনি ভীষণ দায়িত্বশীল। সবকিছুর পর লেখালেখিটাই তার কাছে টিকে থাকে। তার ভাষ্যমতেই-

অধিকাংশ সময় এটাই একমাত্র
জিনিস
তোমার আর
অসম্ভবের মধ্যবর্তী।
কোনো নেশা,
কোনো নারীর প্রেম,
কোনো সম্পদ
এটার সাথে তুল্য নয়।

(লেখা)

নেহাতই নামকাওয়াস্তে কবি ছিলেন না তিনি। আমাদের জীবনানন্দের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। বরং কবি হওয়ার চেয়েও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো কবিতা সৃষ্টি করতে পারা। ‘সে বেশ্যার প্রতি যে আমার কবিতা নিয়ে গেছে’ কবিতায় তিনি ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে বলেন-

কিন্তু ঈশ্বর বলেছেন,
পায়ের ওপর পা তুলে,
আমি দেখছি অনেক কবিই সৃষ্টি করেছি
কিন্তু খুব বেশি সৃষ্টি হয়নি
কবিতা।

(সে বেশ্যার প্রতি যে আমার কবিতা নিয়ে গেছে)

কবিতা সৃষ্টির জন্যই জীবনের সব আয়োজন তার। আপাতভাবে যে উদ্দাম, লাগামহীন জীবন তিনি যাপন করেছেন, তার অন্তর্গত কারণটি যেন কবিতাই। ‘সে বেশ্যার প্রতি যে আমার কবিতা নিয়ে গেছে’ কবিতায় তাই তিনি মিনতি করেন-

পরেরবার আমার বাম হাত নিয়ে যেয়ো অথবা অর্ধেকটা
কিন্তু আমার কবিতা নিয়ো না :

(সে বেশ্যার প্রতি যে আমার কবিতা নিয়ে গেছে)

আদতে বুকোস্কির হাত কিংবা তার যেকোনো কিছুই নিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু তার কবিতা নেওয়া যায় না। কবিতা আর বুকোস্কি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।

 

আরও পড়ুন- চার্লস বুকোস্কি’র কবিতা

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.