:
Days
:
Hours
:
Minutes
Seconds
Author Picture
স্বাক্ষর শতাব্দ

অনুবাদক, সাহিত্য সমালোচক

ফয়জাবাদ ৩১২২৩
প্রচ্ছদ: রাজিব রায়

হিলাল ভাট

ফয়জাবাদ ৩১২২৩

ঊনিশ শ সাতাশি সাল, যে বছরে আমি পঞ্চম শ্রেণি পাশ করেছিলাম, সে বছরটা আমার জন্মভূমির ইতিহাসেও নতুন মোড় নিয়ে আসে। আমার জন্মভূমি, কাশ্মীর। সে বছরই প্রথম ও শেষ বারের মতন আমার দেশের সর্বস্তরের মানুষেরা এই ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীরে নিজেদের সরকার গঠনের স্বপ্ন নিয়ে গণহারে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল।

চারটার দিকে আমার স্কুল শেষ হতো। এর পর দ্রুত বাড়ি ফিরে দক্ষিণ কাশ্মীরে অবস্থিত আমাদের গ্রামের অন্য বাচ্চাদের সাথে মিলে মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্টের মিছিলে যোগ দিতে যেতাম। এমইউএফ ছিল একটা জোট- স্থানীয় স্বাধীন রাজনৈতিক দলগুলি মিলে, যারা এক হয়ে নির্বাচনে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিপরীতে ছিল  দিল্লীর অধীনস্ত প্রার্থীরা বা দুই পার্টি তথা জাতীয় কনফারেন্স ও কংগ্রেসের প্রার্থীরা।

সৈয়দ সালাহউদ্দিনের (বর্তমানে ইসলামিক সশস্ত্র প্রতিরোধ মৈত্রী ইউনাইটেড জিহাদ কাউন্সিলের প্রধান) মতন অনেকেই যারা পরে বিচ্ছিন্নতাবাদী এমনকি সশস্ত্র হয়ে গিয়েছিল, সবাই মিলে একাট্টা হয়েছিল রাজ্যে একটা জনগণের সরকার স্থাপনের জন্য।

১৯৮৭ সালের সেই দুর্ভাগ্যজনক নির্বাচনের আগেও মানুষের মনের মধ্যে এই ধারণাটাই ব্যাপকভাবেই প্রোত্থিত ছিল যে কাশ্মীরের জনগণকে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুষ্ঠু সু্যোগ থেকে সবসময়ই বঞ্চিত করা হয়েছে। এই ধরণের প্রথম নির্বাচন অর্থাৎ সেই ১৯৫১ সাল থেকে শুরু করে শাসক দল সব সময়েই ছিল নয়াদিল্লী থেকে ঠিক করে দেয়া। কাশ্মীরের নেতৃত্বের একটা অংশ সবগুলি নির্বাচন বর্জন করে এসেছিল। তাদের দাবি ছিল ১৯৪৮ এর জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে গণভোট এর বাস্তবায়ন। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনকে এমইউএফ দেখছিল গণভোটের দিকে একটা পদক্ষেপ হিসেবে।

মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্টের আবির্ভাবের ফলেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি পুনরায় আস্থা স্থাপন করা সম্ভব হয়ে উঠেছিল। মানুষজন এমইউএফ এর প্রার্থীদেরকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন দিচ্ছিল। এমইউএফ এর পতাকার রংয়ে রঞ্জিত কাশ্মীরের পথঘাট, বাজার আর ঘরের চালগুলি আরো আরো সবুজ হয়ে গিয়েছিল। এই বছরের কাশ্মীরের নির্বাচনে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি ঘটেছিল। কিন্তু ফলাফলে সবাইকেই হতাশ হতে হয়। এমএইউএফ যে চুয়াল্লিশটা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তার মধ্যে মাত্র চারটিতে জয়লাভ করে, অপরদিকে জাতীয় কনফারেন্স-কংগ্রেস জোট ছেষট্টিটি আসন পায়। ভোট গননায় কারচুপি এবং ব্যালট বাক্স বদলের নানা কেচ্ছা-কাহিনী ঘরে-ঘরের সবাই জেনে গিয়েছিল। চৌদ্দ বছরে বয়সের উপরের শিশুকিশোররাও নিজেদের লিবারেশন ফ্রন্ট, হিজবুল মুজাহিদিন, আল-উম্মাহর এবং অন্যান্য স্থানীয় গেরিলা বাহিনীর ক্যাডার হিসেবে নাম লেখাতে শুরু করলো।

দশ-বারো জনের মতন একটা বালকের দল সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তান চলে যেত, সেখান থেকে গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাশ্মীরে ফিরে আসতো ভারতীয় দখলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। প্রত্যেক দিন আমরা খবর পেতাম আরো আরো শিশুরা এই সব দলে নাম লেখাচ্ছে, এবং সীমান্তবর্তী জেলা কুপওয়ারাবারামুল্লাহর দিকে যাচ্ছে। ওখানে তারা লাইন অফ কন্ট্রোল (এলওসি) বা নিয়ন্ত্রণরেখা বা পাকিস্তান ও ভারতের দখলকৃত কাশ্মীরের অঘোষিত সীমান্তরেখা পার করতো। আমাদের স্কুলের বাচ্চারাও অপেক্ষায় ছিল কবে তাদের সময় আসবে, তারাও সশস্ত্র যোদ্ধা হবে, বীর হবে।

আমাদের স্কুলের অধ্যক্ষের বয়স ছিল চল্লিশের ঘরে। লম্বা, অত্যন্ত শীর্ণকায় এই মানুষটি ছিলেন জামাত-ই-ইসলামীর সমর্থক। আমার এখনো সেই দিনের কথা মনে আছে। সেদিন তিনি ক্লাশের মধ্যেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি ভারতের উপরে সমস্ত আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন এবং ছাত্রদেরকে সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন, “তোমরা দেখেছ নির্বাচনে কী ঘটেছে। ভারত আমাদেরকে কখনোই নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচনের মতন মৌলিক অধিকারটুকু দেবে না। কাশ্মীর দখল হয়ে গেছে। শান্তি আর মর্যাদা শুধু বন্দুকের নলের মধ্য দিয়েই অর্জিত হতে পারে।” ক্লাশরুমে এই ছিল তার শেখানো শেষ পাঠ।

এক সপ্তাহ পার না হতেই অধ্যক্ষের এলওসি পার করার খবর নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল। মুজাফফরাবাদের কাশ্মীরীদের একগুচ্ছ নামের মধ্যে তার নামও ছিল, যারা ওখানকার রেডিও কাশ্মীরে একটা কাশ্মীরি গানের জন্য অনুরোধ করছিল এবং গানটা উৎসর্গ করেছিল নিয়ন্ত্রণরেখার এই পাশের বন্ধুদের। নিয়ন্ত্রণরেখার মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন পরিবারের সদস্যরা আজাদ কাশ্মীর রেডিওর মাধ্যমে প্রায়ই তাদের বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের সাথে যোগাযোগ করত। এর ফলে দুই অংশের কাশ্মীরের মানুষের কাছেই এটি অনেক জনপ্রিয় স্টেশন ছিল। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনের পরে এটা আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

আমরা খবর পাই, অধ্যক্ষ তার সাথে তার নিজের চৌদ্দ বছর বয়সের ছেলেকে এবং নবম শ্রেণির আরো তিনজন বালককে নিয়ে গেছেন গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষিত করার জন্য। এই খবরে আমাদের স্কুলজুড়ে একটা চাঞ্চল্য তৈরি হলো। আমার ক্লাশমেটরা সবাই দুইটা “জীবনের লক্ষ্য” রচনা তৈরি করে ফেললো। প্রথমটা আমাদের পন্ডিত শিক্ষকের জন্য, তার নাম ছিল সোমনাথ। আরেকটা হলো আমাদের অধ্যক্ষের দেয়া শেষ পাঠ, যা এরই মধ্যে আমাদের সকলের আত্মার ঘোষনাপত্রে রুপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল।

আমরা খবর পাই, অধ্যক্ষ তার সাথে তার নিজের চৌদ্দ বছর বয়সের ছেলেকে এবং নবম শ্রেণির আরো তিনজন বালককে নিয়ে গেছেন গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষিত করার জন্য। এই খবরে আমাদের স্কুলজুড়ে একটা চাঞ্চল্য তৈরি হলো। আমার ক্লাশমেটরা সবাই দুইটা “জীবনের লক্ষ্য” রচনা তৈরি করে ফেললো। প্রথমটা আমাদের পন্ডিত শিক্ষকের জন্য, তার নাম ছিল সোমনাথ। আরেকটা হলো আমাদের অধ্যক্ষের দেয়া শেষ পাঠ, যা এরই মধ্যে আমাদের সকলের আত্মার ঘোষনাপত্রে রুপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল।

স্কুলের বিরতির সময় আমরা প্রায়ই পাশের আপেল বাগানে বসে রচনার গোপন প্রকরণটা নিয়ে কথা বলতাম। আমাদের ক্লাশের একজনও বাকী ছিল না, এমনকি মেয়েরাও, সবারই লক্ষ্য ছিল, সবাই হবে মুজাহিদিন- যোদ্ধা।

এক বছর পর, যেসব ছেলেরা এলওসি পার করেছিল, তারা ফিরে এলো। জম্মু ও শ্রীনগরকে সংযুক্তকারী ন্যাশনাল হাইওয়ে-১ এ দিয়ে ভারতীয় সেনার যে কনভয়গুলি পার হতো সেগুলির উপর সময়-সময়ে গুলিবর্ষন করে এই ছেলেরা নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করেছিল। এই ছেলেরা মাঝে মাঝেই হাইওয়ের কালভার্টগুলির নিচে ল্যান্ডমাইন এবং নিজস্ব উদ্ভাবিত বিস্ফোরক যন্ত্র পুঁতে রাখতো। স্থানীয়ভাবে এই আক্রমণগুলিকে আমরা একশন বলতাম। প্রত্যেকবার এই একশনগুলির ঠিক পরেই  মানুষ গণহারে গ্রামগুলি থেকে পালাতে শুরু করতো। সেনাবাহিনী এসে ছেলেদের সন্ধান শুরু করার আগে আগে। সৈন্যরা এসে জোরপূর্বক ঘর-বাড়ির ভেতর ঢুকে শিশুদেরকে মারধর করতো। এর পরের প্রত্যেক দিন, আরো আরো শিশুরা সীমান্ত পার করে যোদ্ধা হবার শপথ নিত।

আমাদের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার সময় ছেলেরা পরীক্ষার হলে পকেটে পিস্তল লুকিয়ে পাহারা দিত। তারা নিশ্চিত করত যে কেউ নকল করছে না বা দেখে লিখছে না। কিছু পরীক্ষা পরিদর্শকের উপরেও নজর রাখতে হতো যারা ছাত্রদের থেকে টাকা খেয়ে তাদেরকে সাহায্য করত পরীক্ষায় পাশ করার জন্য।

যেসব ছেলেরা পরীক্ষায় ফেল করত, তারা দেখলো পরীক্ষা পাশের চেয়ে অস্ত্র গ্রহণ করে যোদ্ধা হয়ে গ্রামের সামনে নিজের পায়ে দাঁড়ানো সহজতর। এদের মধ্যে একজন হলো শাবির। সে দশম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার আগে মুজাফফরাবাদ চলে গিয়েছিল এবং তিনবছর পরে ফিরে এসেছিল অস্ত্র নিয়ে। তার বন্দুকের মতন অত বড় বন্দুক আমি আর কখনোই দেখিনি।

গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় ছেলেরা প্রায়ই শীতের মধ্যে পড়ার জন্য উলের তৈরি কাশ্মীরি গাউন বা ফিরেনের মধ্যে তাদের বন্দুকগুলিকে লুকিয়ে নিয়ে যেত। আমার ক্লাশমেটদের প্রিয় ছিল এর আগের দিন রাতে দেখা কালাশনিকভধারী যোদ্ধাদের চিনতে পারার গল্প।

রাত হলেই যোদ্ধারা থামতো এবং গ্রামের কোন  একটা বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে রাতটা অতিক্রান্ত করে পরের দিন ভোরের আগেই আবার যাত্রা শুরু করত। কদাচিৎ অনেক বড় দলে তাদেরকে দেখা যেত, তারা হেঁটে চলেছে কাঁধের উপর ঝোলানো নানান আকার-প্রকারের বন্দুক।

১৯৮৯ সালের এক সন্ধ্যারাতে আমাদের বাড়ির ইটের দেয়াল টপকে লাফিয়ে দুটো ছেলে আমাদের রান্নাঘরের দরজা দিয়ে আমাদের ঘরের মধ্যে আসে। আমি তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। আমরা ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম, তারা ফিরেনের মধ্যে থেকে একে-ফোর্টিসেভেন বের করে বসার ঘর দখল করে থাকা আখরোট গাছের তক্তা দিয়ে তৈরি মোটা চৌকিটার নিচে রাখছিল।

আমার আম্মা তাদের জন্য রাতের খাবার তৈয়ার করেছিলেন। তারা খেয়েদেয়ে, নামাজ পড়ার পর ঘুমিয়ে গিয়েছিল। আমরা কেউই ঘুমোতে পারিনি। মধ্যরাতে আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আব্বা যে জানালাটা দিয়ে গ্রামের রাস্তাটা দেখা যায় তার ধারে দাড়িয়ে তামাক খাচ্ছিলেন। আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল, সৈন্যদের কথা ভেবে। তারা যদি আমাদের বাড়িটা ঘিরে ধরে? তারপর আমাদের অতিথিদের সাথে গুলি-বিনিময় শুরু করে? তবে তার চেয়েও বেশি উত্তেজনা ছিল বসবার ঘরের আখরোট কাঠের চৌকির নিচে রাখা একে ফোর্টিসেভেনগুলিকে ঘিরে। আমার একটাকে ছুয়ে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। একবার ট্রিগার চেপে একটু শক্তি পরীক্ষা করার। আমি আমার ক্লাশমেটদের কাছে তাহলে গল্প করতে পারতাম সত্যিকারের একেফোর্টিসেভেন কতটা ভয়ংকর, কতটা শক্তিশালী।

আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে গিয়ে চুপি চুপি বসবার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। ছেলেরা গভীর ঘুমে অচেতন ছিল। আমি বিছানার কাছে গিয়ে একটা রাইফেল হাতে নিলাম এবং আমার ফিরেনের নিচে লুকিয়ে ফেললাম। দরজা খোলার আগে পেছনে তাকিয়ে ওরা আমাকে দেখেছে কিনা তা নিশ্চিত করলাম এবং এরপর বাড়ি থেকে বের হয়ে গ্রামের বাইরের খোলা মাঠের দিকে চলে গেলাম, হাতে কালাশনিকভ। আমার সমস্ত শরীর জুড়ে আশ্চর্য শক্তি অনুভব করলাম। ফিরেনের মধ্যে বন্দুক নিয়ে আমার চালচলন পূর্ণবয়স্কদের মতন ভারিক্কি ও দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। নির্ভীক চিত্তে আমি ভোরবেলা গ্রামের বেকারির কাছে রুটির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলিকে পার হয়ে হেঁটে গেলাম। গ্রামের সীমানার কাছের সিমেন্ট বাধানো ঝর্ণার ধারটা পার হয়ে এলাম, এখানে সকাল সকাল গ্রামের মহিলা ও মেয়েরা এসে জড়ো হয়ে তাদের বাসন কোসন ধোয়াধোয়ি করে আর ছেলেদের নিয়ে গাল-গপ্পো করে। আধ মাইল পরে পাহাড়ের উপর সমতলভূমিটার পাশে একটা খোলা সরিষার ক্ষেতের কাছে এসে পৌছলাম। পেছনে ফিরে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম আশেপাশে কেউ নেই। ফিরেন থেকে রাইফেলটা বের করে দেখলাম, এবং একটা গভীর নিশ্বাস নিলাম। ট্রিগার চেপে এর শক্তি পরীক্ষা করার আগেই আব্বা পেছন থেকে এসে থাপ্পড় লাগালেন এবং বন্দুকটা নিয়ে নিলেন।

বাচ্চারা সীমানা পার হয়ে যোদ্ধা হয়ে যাবে এই ভয়ে অনেক বাবা-মা’ই তাদের সন্তানদেরকে উপত্যকার বাইরের স্কুলে পাঠাতে শুরু করেছিলেন। ঐ একে ফোর্টিসেভেন ঘটনার দুই বছর পর আমার বাবামাও তাই করলেন।

১৯৯১ সালে অষ্টম শ্রেণি পাশ করার পর, আমাকে মিন্টু সার্কেল স্কুলে পাঠানো হলো আরো সাতজন কাশ্মীরি বালকের সাথে। শিক্ষার অগ্রদূত স্যার সৈয়দ আহমেদ খান মিন্টু সার্কেলের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৮৭৫ সালে। এটা ছিল দিল্লী-কোলকাতা গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড ধরে দিল্লী থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংযুক্ত একটা বোর্ডিং স্কুল।

এই উত্তর ভারতের সমতলের তীব্র গরমের মধ্যেই আমি প্রথম টের পেলাম, “আমি আর বাড়িতে নেই”। উপত্যকায় বাসকারী কাউকে গ্রীষ্মপ্রধান, শুষ্ক জলবায়ুর এলাকায় থেকে গরমের দিনের  ন্যূনতম ১০০ ফারেনহাইট তাপমাত্রা সহ্য করে থাকতে বলা খুবই নিষ্ঠুর ব্যাপার। বোর্ডিং স্কুলে আমাদের আট জনের জন্য শুরুতে এটাই ছিল সবচেয়ে প্রধান সমস্যা।

ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার আগে বাবরি মসজিদ। ছবিসূত্র: ডয়চে ভেলে।

প্রায়ই রাতের বেলা আমরা ঘর থেকে বের হয়ে যেতাম। উঠানে জড়ো হয়ে আমাদের বাড়ির কথা আলাপ করতাম। আমাদের অরণ্যের বাড়ি, যেখানে নদী আর ঝর্ণার মধ্যে ফুটে থাকে উপত্যকা, যেখানে গ্রীষ্মের শেষ পর্যন্ত হিমালয় বরফের চাদর পরে থাকে এবং যেখানে পাইনের বীজের ঠাণ্ডা সুগন্ধে বাতাস ভরে যায়। মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর যথার্থই একে বলেছিলেন, “ভূস্বর্গ”। এই সবকিছুর ঠিক বিপরীত হলো আমাদের নতুন জায়গা, আলীগড়। যেকোন ছুতায় বাড়ি যাওয়ার জন্য আমরা ব্যকুল থাকতাম।

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর সকাল বেলার সংবাদপত্রে খবর এলো যে প্রায় ১৫০,০০০ করসেবক (হিন্দু জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক) অযোধ্যার বাবরি মসজিদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানকার বিতর্কিত ভূমি দখল করার জন্য। বিপুল সংখ্যায় পুলিশ ও প্যারামিলিটারি নামানো হয়েছিল করসেবকদের অযোধ্যা প্রবেশে বাঁধা দেয়ার জন্য।

প্রায় দুই শতাব্দী ধরে ভারত শাসন করা মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ১৫২৭ সালে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। অনেক বছর ধরেই ভারতে এই বিষয় নিয়ে খুবই আশংকাজনক রাজনীতিকরণ হয়ে এসেছে। মূলধারার ভারতীয় জনতা পার্টিসহ ডানপন্থী হিন্দুদের দাবি এই মসজিদের পূর্বনাম ছিল মসজিদ-ই-জন্মস্থান (জন্মস্থানের উপরে নির্মিত মসজিদ), এবং সেই থেকে প্রমাণ হয় যে এই স্থান হিন্দুদের ইষ্টদেবতা রামের জন্মভূমি। এর থেকে তাদের উপসংহার হলো, তাদেরকে এই মসজিদ গুড়িয়ে এই একই স্থানে একটি হিন্দু মন্দির নির্মাণ করতে দিতে হবে।

৬ ডিসেম্বর দুপুরের পর আমরা যখন খাচ্ছিলাম, তখন খবর পেলাম করসেবকরা নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙ্গে মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করেছে। কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ভর করলো আমাদের ছাত্রাবাসের মধ্যে। কয়েক ঘন্টা পর খবর এলো, করসেবকেরা মসজিদের তিন-তিনটা বিশাল গম্বুজের উপরে উঠে মসজিদটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে।

খবর আসার সাথে সাথেই আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫,০০০ ছাত্র একত্র হয়ে অনুপসাহরা রোডের প্রতিবাদে জড়ো হয় এবং এক ডজন যান-বাহন পুড়িয়ে দেয়। শেষ রাতের দিকে কর্তৃপক্ষ দাঙ্গাকারী ছাত্রদের উপরে নিয়ন্ত্রণ আনতে সক্ষম হয়।

পরের দিন খুব ভোর থেকে আলীগড় ও উত্তর প্রদেশের অন্যান্য শহর এবং দিল্লী ও মুম্বাইয়ে কার্ফিউ জারি করা হয়। কথিত আছে, এর পরবর্তী দাঙ্গায় প্রায় ২,৫০০ হিন্দু-মুসলিম প্রাণ হারায়। দাঙ্গার পর পর আলীগড় শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাশের সিভিল লাইন এলাকায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য কার্ফিউ জারি করা হয়।

সন্ধ্যার দিকে আমার এক কাশ্মীরি বন্ধু, ফারহাত উন্মত্তের মতন ছুটে এসে দরজায় কড়া দিয়ে এসে জানায়, কার্ফিউ সম্ভবত অনেকদিন ধরেই বলবৎ থাকবে এবং কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাস অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করার চেষ্টা করছে। তারা ছাত্রদের জন্য বিশেষ বাসের যোগাড় করছে, এই বাসগুলিকে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর সাহায্যে পাহারা দিয়ে স্টেশনে পৌছে দেয়া হবে। সেখান থেকে ছাত্ররা তাদের বাড়ি যাওয়ার জন্য ট্রেনে চড়বে। ফারহাত আমাকে জানালো যদি আমি বাড়ি যেতে চাই তাহলে পরের দিন সকালে আমাকে প্রক্টরের অফিসে থাকতে হবে রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যাবার আগে। এরপর সে আসিফ বোধা নামের মিন্টু সার্কেলের আরেক কাশ্মীরী ছাত্রকে জানানোর জন্য ছুটে গেলো।

দাঙ্গার কারণে স্কুলের খাবার সরবরাহকারীরা নিয়মিত খাবার পৌছাতে পারেনি। সে রাতে আমাকে আধপেটা হয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হয়েছিল, না খেয়ে থাকার জ্বালা ভালোই টের পেয়েছিলাম। ঘরে তৈরি নানান পদের মাংস সম্বলিত কাশ্মীরি ভোজ, ওয়াজওয়ানের জন্য কাতর হয়ে গিয়েছিলাম।

পরের দিন সকালে ডাইনিং হলে চা আর বাসী রুটি দিয়ে নাস্তা সেরে সরাসরি ফারহাতের রুমে গেলাম এবং তাকে জানালাম যে আমিও বাড়ি যাচ্ছি। নিজের ঘরে গিয়ে খুব দ্রুত আমার জিনিসপত্র একটা সুটকেসে ভরতে থাকলাম। এর আগের বছর আমি বার্ষিক পরীক্ষার পরে আমার নবম শ্রেণির বইপত্র বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার আম্মা, যিনি নিজেও একজন শিক্ষক, ইসলামিক সাহিত্য খুবই পছন্দ করেন। আমার নবম শ্রেণির ধর্মবিদ্যার বইগুলি পড়ে আম্মা খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। ওটি ছিল একটা উর্দু বই- ইসলামী কৌতুকের। আম্মা বলে দিয়েছিলেন আমি যেন আমার দশম শ্রেণির ধর্মবিদ্যার বই শীতের ছুটিতে বাড়ি আসার সময় অবশ্যই সাথে নিয়ে আসি।

আমি বইটা কয়েকটা টি-শার্ট আর জিন্সের প্যান্টের সাথে সুটকেসে ভরে দৌড়ে ফারহাতের ঘরে আসি। ফারহাত ছিল খাটোমতন শক্ত-সামর্থ একটা ছেলে, বেশিরভাগ সময় পড়ার ঘরেই কাটাত। বাড়ি ফেরার উত্তেজনায় সে টগবগ করছিল। আমরা বাস ধরার জন্য প্রক্টরের অফিসের কাছে চলে গেলাম এবং আমাদের অন্যান্য কাশ্মীরি বন্ধুদের দেখে অত্যন্ত খুশি হলাম।

স্কুল থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার পার করে বাসটা ইউনিভার্সিটির সরু রাস্তা দিয়ে আলীগড়-অনুপসাহরা রোডে গিয়ে উঠলো। এই রাস্তার দুইপাশের ধ্বংসলীলা দেখে আমরা হত-বিহ্বল হয়ে গেলাম। দাঙ্গাকারীদের লাগানো আগুনে পুড়ে বাসগুলি লোহার কঙ্কাল হয়ে আছে, রাস্তার পাশের খাবারের ধাবাগুলির ধ্বংসাবশেষ এখানে সেখানে পড়ে আছে। অস্ত্রসজ্জিত ভর্তি দাঙ্গাপুলিশের ট্রাক তসভির মহলের কাছে সারি সারি করে দাঁড় করানো। তসভির মহল একটা সস্তা সিনেমা হল, এখানে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আর রিক্সাওয়ালারা সিনেমা দেখতে যেত।

সে আমার কণ্ঠনালী কেটে ফেলার আগেই আমি চিৎকার করে উঠলাম, “আমি কাশ্মীরি পণ্ডিত। দয়া করে আমাকে মেরে ফেলবেন না। আমার কাকাকে কাশ্মীরে সন্ত্রাসীরা মেরে ফেলেছে। কাশ্মীরের মুসলমানেরা আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলেছে। আমাদেরকে উপত্যকা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি জম্মুতে একটা শরনার্থী শিবিরে বড় হয়েছি।”

আমরা প্রায় দুইটার দিকে রেলস্টেশনে গিয়ে পৌঁছলাম। বেশ লম্বা লাইন ছিল। সম্প্রতি আলীগড় রেলস্টেশন কম্পিউটারাইজড হয়েছে। টিকেট অপারেটর নতুন কম্পিউটারের কীবোর্ড নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল। মনিটরটা তখনো একটা স্বচ্ছ পলিথিনে মোড়ানো। টিকেট অপারেটরের সাথে মানুষজন যখন এমনি কথাবার্তা ও বচসা করছিল তখন একটা ঘোষণা আসলোঃ

“সম্মানিত যাত্রী সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ফয়জাবাদ থেকে ছেড়ে আসা নয়াদিল্লীগামী ফয়জাবাদ স্পেশাল ৩১২২৩ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্ল্যাটফর্ম নম্বর ৩-এ এসে দাঁড়াবে। যে সকল যাত্রীবৃন্দ দিল্লী যাচ্ছেন তাদেরকে প্ল্যাটফর্ম নম্বর ৩-এ এসে দাড়ানোর জন্য অনুরোধ করা হলো। ভারতীয় রেলওয়ে আপনার আনন্দদায়ক ও আরামপ্রদ ভ্রমণের জন্য শুভকামনা জানাচ্ছে।”

আমরা বাড়ি ফেরার আনন্দে এতটাই উদ্বেলিত ছিলাম যে, কেউই খেয়াল করিনি যে এটা প্রত্যেকদিনকার সাধারণ ট্রেন না, বরং ফয়জাবাদ থেকে ছেড়ে আসা একটা বিশেষ ট্রেন, যেখানে মাত্র এক দিন আগে করসেবকরা প্রলয় ঘটিয়েছে।

আমরা তড়িঘড়ি করে প্ল্যাটফর্ম ৩ এ চলে গেলাম। এক মিনিট অপেক্ষা করার পর আমরা ট্রেনের বাঁশির তীব্র আওয়াজ শুনতে পেলাম। প্ল্যাটফর্মে খুব বেশি লোকজন ছিল না। দাঙ্গার কারণে এমন আতংক ছড়িয়েছিল, যার রেশ রেল স্টেশনের জীবনেও এসে পড়েছিল। লাল পোশাকের কুলি, বা টি-স্টল, ম্যাগাজিন বা পত্রিকা বিক্রেতাদের দেখা যাচ্ছিল না।

ইঞ্জিনের গর্জনের শব্দের মধ্য দিয়ে আমরা ট্রেনে চড়ে বসলাম। আমার পেছনেই ছিল ফারহাত ও জাবিদ ইন্দ্রাবি। জাবিদ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র। ও যাচ্ছিল দক্ষিণ কাশ্মীরে তার গ্রামের বাড়ি রত্নিপুরার দিকে।

আমাদের বাদবাকি কাশ্মীরি ছাত্ররা পেছনের দরজা দিয়ে একই বগিতে উঠে গেল। ভেতরে ঢোকার পর, অর্ধ-ঘুমন্ত যাত্রীদের পার করে আমরা ওদের দিকেই যেতে থাকলাম। এই বগিটা একেবারে ঠেসে ভরা। চার-পাচটা বার্থ পার করার পরে আমি বসার জায়গা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে সুটকেসটা নামিয়ে আমার দুই পায়ের মাঝে রাখলাম। আমি আইলে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমার থেকে কয়েকটা বার্থ পেছনেই ফারহাত ও জাবিদ। ফারহাত চুইং গাম চিবোতে চিবোতে আমার দিকে তাকাচ্ছিল, তার ঠিক পেছনেই জাবিদ। তার পরনে ছিল গলা থেকে আস্তিন পর্যন্ত সাদা ডোড়া দেয়া একটা নীল পুলওভার, ওয়াকম্যানে গান শুনছিল।

আমার চোখ গেলো করিডোরের অন্যপাশের বার্থগুলির দিকে। বগিটার নিচের দিকের বার্থগুলিতে প্রায় দশজন করে মানুষ একে অপরের মুখোমুখি বসেছিল। কেউ কেউ তাস খেলছিল, বাকিরা তাকিয়ে দেখছিল এবং প্রায় অর্ধেকের মতন লোক বিড়ি টানছিল। সাদা গেঞ্জি ও ধুতি পড়া একটা লোক, তার বাম হাতে কয়েকটা তাস ধরা ছিল, ডান হাতে বিড়ি, আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “ভাইয়া আগে চালো, আগে!” (ভাই, সামনের দিকে যাও)

আমি উত্তর দিলাম, “আগে কাহাঁ, আগে কোয়ি জাগা নাহি হ্যায়।” (সামনে কোন জায়গা নেই)

লোকটা একটু থামলো। আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো, “আরে ইয়ে তো কাশ্মীরি লাগতা হ্যায়।” (আরে একে তো দেখতে কাশ্মীরি মনে হচ্ছে)। আমি আর একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারার আগেই সে বল উঠলো, “মারো!” (একে মেরে ফেলো)

কিছুক্ষণ পর, উপরের বার্থ থেকে মানুষেরা নিচে নেমে এলো, আমার উপরে ঝাপিয়ে পরে, কেউ কেউ ঘুষি দিতে লাগলো, কেউ চড়-থাপ্পড়, কেউ কেউ লাথি দিতে লাগলো। একজন মোটাগোছের লোক আমাকে পেছন থেকে ধরে রেখেছিল এবং আমার থুতনির নিচে গলার কাছে একটা ছুরি ধরলো। সে আমার কণ্ঠনালী কেটে ফেলার আগেই আমি চিৎকার করে উঠলাম, “আমি কাশ্মীরি পণ্ডিত। দয়া করে আমাকে মেরে ফেলবেন না। আমার কাকাকে কাশ্মীরে সন্ত্রাসীরা মেরে ফেলেছে। কাশ্মীরের মুসলমানেরা আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলেছে। আমাদেরকে উপত্যকা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি জম্মুতে একটা শরনার্থী শিবিরে বড় হয়েছি।”

তারা থামলো। এর মধ্যে একজন, ঐ দলের সর্দার গোছের, সে একজন সহযাত্রীকে লাথি মেরে তার আসন থেকে সরিয়ে আমাকে বসার আদেশ করলো।

“তোমার নাম কি?”

“হিলাল ভাট।” আমি শেষের এর উপরে বিশেষ জোর দিলাম যাতে হিন্দু উচ্চারণের মতন হয়।

“তোমার বাবার নাম কী?” লোকটা জিজ্ঞেস করলো।

“বদ্রী ভাট।” আমি উত্তর দিলাম। আমি কাশ্মীরের আমার পণ্ডিত বন্ধু, শিক্ষক ও প্রতিবেশীদের থেকে কিছু হিন্দু নাম জানতাম। আমার আব্বার আসল নাম বশির এর প্রথম অক্ষরের সাথে মিলিয়ে নাম হল বদ্রী।

ফয়জাবাদ রেল ষ্টেশন। ছবি: সংগৃহীত।

এর পরে আর কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলো না। বার্থের কোনার দিকের একটা আসন পাওয়ার পরে আমি উলটো দিকের সিটের নিচে কতগুলি ভাঙ্গা ইটের টুকরা দেখতে পেলাম। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে, একজন সহযাত্রী জানালেন এগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজদের থেকে খুলে নেয়া ইটের টুকরা। এগুলি তাদের বিজয় নিশানা, যা তারা সগর্বে তাদের গ্রামে নিয়ে যাচ্ছে প্রদর্শনের জন্য। আমি বুঝতে পারলাম এরা হচ্ছে সেই করসেবকেরা, যারা অযোধ্যা থেকে ফিরছে।

এর পরে যা যা ঘটে গেলো তার সম্বন্ধে আমার স্মৃতি অনেকটা টিভি পর্দায় ঘটতে থাকা দ্রুত লয়ের একশন দৃশ্যের মতন, হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেলে যা শুণ্য পর্দায় পর্যবসিত হয়।

করসেবকেরা ফারহাত ও জাবিদকে আক্রমণ করে বসলো। ওরা আমার মতন পরিচয় লুকোতে পারলো না। আমার মনে পরে ফারহাত দুইহাত দিকে তার মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। আর ঠিক তখনই একজন একটা ত্রিশুল (ভগবান শিবের প্রতীকা, করসেবকদের অনেকেই সেটা বহন করছিল) ফারহাতের বুকে বিঁধিয়ে দেয়, সাথে সাথে তার গগন বিদারী চিৎকার, “হাতাই মোজাই!” (ওহ আম্মা!)

জীর্ণ পোশাক আশাকের একজন লোক ওর ঘাড়ের কাছে একটা ছুরি বসিয়ে দেয় আর আমার বন্ধুর গলা দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে থাকে। এর পরেই টিভির সেই বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার মুহুর্তঃ সবকিছু শূন্য হয়ে গেলো।

সেই আমি শেষবারের মতন আমার বন্ধুটিকে দেখেছিলাম। জাবিদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল আমি জানি না, ওকে আক্রমণ করা হয়েছিল, আমার থেকে আরো কয়েকটা দূরের বার্থে, আমার দৃষ্টি সীমার বাইরে। এই ঘটনার আরো মাস খানেক পরে জাবিদের পরিবার বুলন্দ শহর এর কাছের এক গ্রামে জাবিদের কবরের সন্ধান পেয়েছিল। একজন স্থানীয় ইমাম তার জানাজার ব্যবস্থা করেছিলেন। ফারহাতের লাশ তিনদিন বাদে তার বাড়ি পৌছে।

পাঁচ থেকে দশ মিনিট পর দলের সর্দার ফিরে এলো, সাদা গেঞ্জিতে রক্ত মাখা। আমি তাকে বলতে শুনলাম, “ওদেরকে কেটে টুকরো টুকরো করে ছুড়ে ফেলেছি।” সে নিজের রক্তমাখা গেঞ্জিটা খুলে ট্রেনের জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল।

আমার দিকে ফিরে সে জানালো, আমি যে আমার পরিচয় জানিয়েছি তাতে সে খুবই প্রসন্ন, এবং এর পরের বার বৈষ্ণু দেবীর মন্দির দর্শনের জন্য জম্মু  গেলে আমার সাথে দেখা করবে এই মর্মে কথা দিলো। জম্মুর পাহাড়ের কোলের এই মন্দিরটা খুবই বিখ্যাত, প্রত্যেক বছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এর দর্শন করতে যায়।

ট্রেন ছুটে চললো দিল্লীর দিকে। খুরজাহ’র কাছে একটা ক্ষীপ্ত মুসলিম জনতার দল রেললাইনের কাছে ইট-পাথর জড়ো করে জমায়েত হয়েছিল। ‘ফয়জাবাদ স্পেশাল’ ঐ জায়গা অতিক্রম করতে শুরু করলে তারা পাথর ছুড়তে লাগলো। করসেবকেরা জানালার উপরের লোহার পর্দা টেনে দিয়ে এরই মধ্যে শ্বাসরোধ হয়ে আসা বগিটাকে আরো অন্ধকার করে দিল।

কয়েক মিনিট পর, কেউ একজন ঘোষণা করল যে বগির মধ্যে আরো কাশ্মীরি আছে। কয়েকজন করসেবক ত্রিশূল, ছুরি আর তরবারি হাতে ছুটে গেলো এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমার বাকীসব কাশ্মীরি বন্ধুদের আটক করলো। আমি যে বার্থে বসেছিলাম, সেটি খালি করে, তাদেরকে সেখানে বসতে বলা হলো।

করসেবকেরা তাদের সব ব্যাগ আর সুটকেসগুলিকে জড়ো করে মূল্যবান জিনিসের জন্য খোঁজাখুঁজি করতে শুরু করে দিল। আমার মায়ের জন্য যে উর্দু বইটা নিয়ে যাচ্ছিলাম, সেটার কথা মনে পড়ায় আমি ভয়ে কাঁপতে শুরু করলাম। আমি সিট থেকে উঠে  আমার সুটকেসটাকে তুলে এরই মধ্যে খোঁজা শেষ হওয়া সুটোকেসগুলির মধ্যে রাখতে চেষ্টা করলাম। দলের সর্দার আমার সুটকেসটা কেড়ে নিল এবং জিজ্ঞেস করলো আমি কী করছিলাম। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, এটা আমার সুটকেস এবং এটা যদি সে খুলে দেখতে চায় তাহলে আমি কিছু মনে করবো না।

“না, এটা তোমার হলে কোন সমস্যা নাই। তুমি আমাদের ভাই। তোমার আসলে আমাদেরকে এই ব্যাগগুলি খুলে দেখায় সাহায্য করা উচিত। ”

রফিক আহমাদ, মৎস্যবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শ্রেণির একজন ছাত্র। সে ছিল ‘ফয়জাবাদ স্পেশাল’ এ কাশ্মীরি ছাত্রদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড়। সে টয়লেটে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু তাকে যেতে দেয়া হয়নি। সে হুমকি দিল যে, সিটের উপর মূত্র ত্যাগ করা ছাড়া তাহলে তার আর অন্য উপায় নেই।

সর্দার তার সাথে দুই পান্ডাকে টয়লেটে পাহারা দিয়ে নিয়ে যেতে বললো। রফিক টয়লেটের ভেতরে প্রবেশ করে দরজার লোহার কড়া লাগিয়ে দিল। একটু পর যখন করসেবকেরা দরজায় ধাক্কা দিতে থাকলো তখন সে উত্তর করলো না। এরপর তারা দরজায় লাথি দিতে লাগলো, রফিক তবুও দরজা খুললো না, “তুই যখন বাইরে আসবি, আমরা তোকে কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলবো।” তার পাহারাদারেরা চিল্লাচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তারাও সিটে ফিরে এলো।

ট্রেনটা খুব ধীরে ধীরে খুরজাহ রেল স্টেশনে এসে পৌছালো। স্টেশনে থামতেই রফিক অতি সন্তর্পনে টয়লেটের দরজা খুলে লাফ দিয়ে ট্রেন থেকে বের হয়ে গেলো।

আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রেল লাইনের মধ্য দিয়ে রফিককে দৌড়াতে দেখলাম। ছুড়ি হাতে করসেবকেরা তার পিছু পিছু ছুটলো চেঁচাতে চেঁচাতে, “কাশ্মীরি দেহশাতগার্দ” (কাশ্মীরি সন্ত্রাসী)

লাফ দিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠতে পারার আগেই একজন করসেবক তাকে ধরে ফেললো এবং মাথার মধ্যে ছোড়া ঢুকিয়ে দিলো। ট্রেনটা বাঁশি বাজাতে বাজাতে স্টেশনের বাইরে ছুটল। করসেবকেরা রফিককে রেললাইইনের ফাঁকে রক্তের মধ্যে শুইয়ে ফেলে রেখে ট্রেনের দিকে ছুটে এলো।

সেই আমি শেষবারের মতন আমার বন্ধুটিকে দেখেছিলাম। জাবিদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল আমি জানি না, ওকে আক্রমণ করা হয়েছিল, আমার থেকে আরো কয়েকটা দূরের বার্থে, আমার দৃষ্টি সীমার বাইরে। এই ঘটনার আরো মাস খানেক পরে জাবিদের পরিবার বুলন্দ শহর এর কাছের এক গ্রামে জাবিদের কবরের সন্ধান পেয়েছিল। একজন স্থানীয় ইমাম তার জানাজার ব্যবস্থা করেছিলেন। ফারহাতের লাশ তিনদিন বাদে তার বাড়ি পৌছে।

আমরা তখনো দিল্লি থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে। কোন নিশ্চয়তা ছিলনা যে তারা আমার পায়জামা খুলে আমি মুসলমান কিনা সেটা পরীক্ষা করবে না। আমি আমার পরিচয় সফলভাবে লুকোতে পেরেছিলাম, কিন্তু এই শারীরিক নিদর্শন লুকানোর উপায় কী? কি বলবো যদি ওরা জিজ্ঞেস করে যে হিন্দু হয়েও আমি কেন মুসলিম বিশ্ববদ্যালয়ে পড়তে চেয়েছি? যদি কেউ আমার সুটকেস খুলে আমার ধর্মবিদ্যার বইটা পেয়ে যায়?

আমি ঠিক করলাম, সুযোগ পেলেই ট্রেন থেকে নেমে পড়তে হবে।

ব্যাগপত্র খোঁজাখুঁজি শেষ হলে সবগুলি কাশ্মীরি ছাত্রকে লাইন ধরে দাঁড়াতে বলা হলো। এর পরে তাদেরকে একে একে চলন্ত ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হলো। এটা একটা ভাগ্যের ব্যাপার যে এদের কারো মৃত্যু হয়নি।

ট্রেন এর পরের স্টেশন গাজিয়াবাদের কাছাকাছি আসলে আমি নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি খুবই বিনীত ভাবে করসেবকদের জানালাম যে আমার একজন কাকা এই শহরে আছেন এবং আমি বাড়ি যাবার আগে তার সাথে দেখা করে যেতে চাই। আমি তাদেরকে আমার জম্মুর ভুয়া ঠিকানা দিলাম এবং পেছনের দরজার দিকে আগাতে থাকলাম। ট্রেনের গতি কমে আসতে থাকলো। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ট্রেনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে থামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাকে কেউ একজন পেছন থেকে এমন জোরে লাথি দিল যে আমি ট্রেন থেকে বাইরে ছিটকে পড়লাম।

আঘাত অগ্রাহ্য করে, আমি উঠে দাড়ালাম, এবং প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনশত মিটার দূরে খাকি পোশাকের একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাঁদতে কাঁদতে তার দিকে ছুটে গেলাম, “আমাকে সাহায্য করুন, দয়া করুন, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে! দয়া করে আমাকে বাঁচান, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে ”

লোকটা জিজ্ঞেস করলো, “কারা তোমাকে মেরে ফেলবে?”

আমি পেছনের দিকে তাকালাম, এবং সেখানে কেউই ছিল না। আমি ভেবেছিলাম ওরা ছুরি হাতে আমার পিছু নিয়েছিল। লোকটা ছিল রেলের একজন পরিচ্ছতাকর্মী, আমি তাকে ফারহাত, জাবিদ ও রফিকের সাথে কী ঘটেছিল তা বললাম।

“তোমার পুলিশের সাথে কথা বলা উচিত। প্ল্যাটফর্ম নম্বর ১-এ একটা পুলিশ ফাঁড়ি আছে।” সে জানালো।

আমি হেঁটে প্ল্যাটফর্মের কাছে গেলাম। এর মধ্যে ‘ফয়জাবাদ স্পেশাল’ চলে গেছে এবং একটা লোকাল ট্রেন লাইনের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি “পুলিশ” লেখা একটা সাইনবোর্ড দেখতে পেলাম। আইম দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। চেয়ারে একজন মধ্যবয়স্ক পুলিশের লোক বসে কতগুলি কাগজ দেখছিলেন, আমি তাকে যা যা ঘটেছিল তা খুলে বললাম।

“তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি আমাদের বড় সাহেবকে ডেকে আনছি।” সে জানালো।

আমি অপেক্ষা  করতে থাকলাম এবং রুমের চারিদিকে তাকিয়ে ফ্রেম আবদ্ধ প্রভু রামের একটা ছবি দেয়ালে ঝুলে থাকতে দেখলাম। ছবিটার উপরে ফুলের মালা চড়ানো ছিল। ফ্রেমটার নিচের দিকে বেশ কিছু আগরবাতির পোড়ানোর পর কাঠিগুলির অবশেষ। নিচের সিমেন্টের মেঝেতে  এদিক সেদিক ছাই পড়ে আছে।

আমি হুট করে সিদ্ধান্ত নিলাম, এখান থেকে পালাতে হবে। আমি দরজা দিয়ে চুপিসারে বের হয়ে এলাম আর একটা দিল্লীগামী লোকাল ট্রেনের খালি কামরায় উঠে গেলাম। আমি ভেতরে ঢুকলাম এবং হঠাত করে দেখলাম কোনার মধ্যে একজন বসে আছে। তার মাথাটা কাপড়ে ঢাকা এবং দুইহাতে তার ব্যাগ শক্ত করে ধরা। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম এবং তার তীক্ষ্ণ চিৎকারে হতচকিত হয়ে গেলাম, “হিলাল!”

আসিফ, আমার মিন্টু সার্কেলের ক্লাশমেট। করসেবকেরা ট্রেন থেকে ছুড়ে দেবার পরেও সে বেঁচে গিয়েছিল। তার ডান হাত ভেঙ্গে গিয়েছিল এবং মাথার আঘাত থেকে রক্ত ঝরছিল। আসিফ তার ব্যাগ থেকে এক জোড়া পায়জামা দিয়ে তার মাথার চারিদিকে বেধে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিল।

লোকাল ট্রেনটা ছেড়ে দিলে আসিফ কাপড় পাল্টালো। তার রক্ত মাখা কাপড় গুলিকে ব্যাগের মধ্যে রেখে দিল। এর পরের একঘন্টায় আমরা আর একটা  কথাও বললাম না। ফারহাত, জাবিদ বা রফিকের কথাও উল্লেখ করলাম না।

নয়াদিল্লী স্টেশনে জম্মুগামী শালিমার এক্সপ্রেস যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা সবগুলি বগিতে পাগড়ি ও দাড়িওয়ালা লোকের সন্ধান করছিলাম। একটা বগিতে পেয়ে গেলাম, এবং বাকী যাত্রাটুকু শিখদের সঙ্গে নিরাপদে পার হলাম।

Meghchil   is the leading literary portal in the Bengali readers. It uses cookies. Please refer to the Terms & Privacy Policy for details.